৫.১ ধ্বন্যাত্মক শব্দ, অনুকার শব্দ ও শব্দদ্বৈত
৫.২ শব্দগঠন : প্রাথমিক ধারণা
৫.৩ কর্ম-অনুশীলন
কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে। যেমন :
ঘেউ ঘেউ (কুকুরের ডাক বা ধ্বনি)
মড় মড় (গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ)
ঠা ঠা (রোদের তীব্রতার অনুভব)
ধ্বন্যাত্মক শব্দ কতগুলো ধ্বনির মিলিত রূপ। এই সম্মিলিত ধ্বনি একদিকে কানে শোনা ধ্বনির অনুকরণে সৃষ্ট, অন্যদিকে মানুষের নানা সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রতীক।
বাংলা ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলোর নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। কিন্তু বাক্যে ব্যবহৃত হলে এগুলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। যেমন :
১. মানুষের ধ্বনির অনুকৃতি :
ভেউ ভেউ : লোকটি ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করল।
হি হি : এত হি হি করে হাসার কারণ কী?
ট্যা ট্যা : কানের কাছে এত ট্যা ট্যা করো না তো, মাথা ধরে গেল। গুনগুন : মেয়েটি গুনগুন করে গান গাইছে।
খক খক : বুড়ো লোকটি খকখক করে কাশছে।
২. জীবজন্তুর ধ্বনির অনুকৃতি :
ঘেউ ঘেউ : কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করছে।
মিউ মিউ : বিড়ালটি মিউ মিউ করে ডেকে কোলে এসে বসল।
কুহু কুহু : বসন্তে কোকিল ডেকে ওঠে কুহু কুহু রবে। কা কা : কাকগুলো একসাথে কা কা করে ডেকে উঠল।
গর গর : তখন বাঘটি রাগে গর গর করতে লাগল।
৩. বস্তুর ধ্বনির অনুকৃতি :
ঘচঘচ : কৃষকেরা ঘচঘচ করে ধান কেটে চলেছে।
মড়মড় : গাছটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। :
গুড়গুড় : গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে।
কলকল : কলকল করে নদী বয়ে চলেছে।
ঝমঝম : ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
৪. অনুভূতির কাল্পনিক অনুকৃতি :
ঝিকিমিকি : ‘চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
ঠা ঠা : ঠা ঠা রোদে ঘুরে বেড়িও না।
কুট কুট : মশা কুট কুট করে কামড়াচ্ছে।
ছম ছম : ভয়ে গা ছম ছম করছে।
চোঁ চোঁ : ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
অনুকার শব্দ
শব্দের অনুকরণে বা বিকারে যেসব শব্দের সৃষ্টি হয়, তাকে অনুকার শব্দ বলে। অনুকার শব্দ ধ্বন্যাত্মক শব্দেরই রকমফের মাত্র। যেমন :
আবোলতাবোল : নোমান সকাল থেকে আবোলতাবোল বকে চলেছে।
কাপড়চোপড় : মা বাইরে যাবার জন্য কাপড়চোপড় পরে তৈরি হয়ে বসে আছেন।
খাবারদাবার : এইমাত্র খাবারদাবার শেষ হয়েছে।
গোছগাছ : জিনিসপত্র গোছগাছ করে নাও, এক্ষুনি বেরুব।
চোটপাট : আমাকে চোটপাট করে কোনো লাভ হবে না।
জড়সড় : ভয়ে ছেলেটা জড়সড় হয়ে আছে।
টেনেটুনে : মেয়েটি টেনেটুনে পাস করেছে।
ফিটফাট : হীরা সব সময় ফিটফাট থাকে।
বকেঝকে : শুধু বকেঝকে কি ছেলেমেয়ে মানুষ করা যায়?
মিটমাট : সমস্যাটা মিটমাট হয়ে গেছে।
রান্নাবান্না : রান্নাবান্না শেষ, এবার খাবার পালা।
শেষমেশ : ঘটনাটি শেষমেশ বড় কর্তার কানে গিয়ে উঠল।
শেষমেশ : ঘটনাটি শেষমেশ বড় কর্তার কানে গিয়ে উঠল।
দ্বিরুক্ত শব্দ
বাংলা ভাষায় কোনো কোনো শব্দ, পদ বা অনুকার শব্দ একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলো দুবার ব্যবহার করলে তার অর্থের সম্প্রসারণ ঘটে বা বিশেষভাবে জোরালো অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। এগুলোকে দ্বিরুক্ত শব্দ বলে। যেমন :
জ্বর (রোগ বিশেষ) : আমার জ্বর হয়েছে।
জ্বর জ্বর (জ্বরের ভাব, জ্বর নয়) : আমার জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে।
মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় এ রকম প্রচুর দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের দ্বিরুক্ত শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. শব্দের দ্বিরুক্তি বা শব্দদ্বৈত
২. পদের দ্বিরুক্তি বা পদদ্বৈত
৩. ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
শব্দদ্বৈত : একই শব্দ পর পর দুবার ব্যবহৃত হয়ে বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করলে তাকে শব্দের দ্বিরুক্তি বা শব্দদ্বৈতবলে।
শব্দদ্বৈত নানাভাবে গঠিত হতে পারে। যেমন :
১. একই শব্দ দুবার ব্যবহার করে :
বছর বছর : বছর বছর পরীক্ষায় ভালো ফল করছ, এতে আমরা সবাই খুশি।
বস্তা বস্তা : কস্তা বস্তা ধান ভরে নিয়ে ট্রাকটি চলে গেল।
ফোঁটা ফোঁটা : বারান্দার ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে।
আস্তে আস্তে : একটু আস্তে আস্তে চল, আমার পায়ে ব্যথা।
চলতে চলতে : চলতে চলতে কথা বলো।
মনে মনে : মনে মনে পড়ার চেয়ে আওয়াজ করে পড়া ভালো।
জনে জনে : সকালে সূর্য ওঠে একথা জনে জনে জিজ্ঞেস করে জানার প্রয়োজন হয় না।
কথায় কথায় : কথায় কথায় তোমার কথা এসে গেল।
খেয়ে খেয়ে : এ সমাজে অনেকেই খেয়ে খেয়ে দেহটা আলুর বস্তার মতো করে ফেলেছে।
বলে বলে : ‘তোকে দিয়ে কিছুই হবে না'- একথা বলে বলে সবুজকে মনোবলহীন করা হয়েছে।
২. একই শব্দের সমার্থক (প্রায়) আর-একটি শব্দ ব্যবহার করে :
আশা-ভরসা : একমাত্র ছেলেটি বাবা-মায়ের আশা-ভরসার স্থল।
আত্মীয়-স্বজন : বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন এসেছে।
কথা-বার্তা : তার সাথে আমার কথা-বার্তা হয়েছে।
চাল-চলন : লোকটির চাল-চলন রহস্যজনক।
ঢাক-ঢোল : ব্যাপারটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে না জানালে কি চলত না?
ধন-দৌলত : কুতুবুদ্দিন সাহেব অনেক ধন-দৌলতের মালিক।
ভয়-ডর : ছেলেটির ভয়-ডর বলে কিছু নেই।
মাথা-মুণ্ডু : তোমার কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না।
সুখ-শান্তি : নেশাগ্রস্ত ছেলেমেয়ের কারণে সংসারে সুখ-শান্তি নষ্ট হয়।
৩. জোড় শব্দের পর অংশ আংশিক পরিবর্তন করে :
কাছাকাছি : কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বাড়ির কাছাকাছি আমরা থাকি।
চেয়েচিন্তে : অনেক চেয়েচিন্তে তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে এনেছি।
ডাকাডাকি : আমাকে ডাকাডাকি করার দরকার হবে না, সময়মতো চলে যাব।
মারধর : এত মারধর খেয়েও চোরটি চুরি করা মালামাল ফেরত দিল না।
রাগারাগি : এসো রাগারাগি না করে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলি।
৪. বিপরীত শব্দযোগে :
আসল-নকল : এখন আসল-নকল চেনা বড় দায়।
আসা-যাওয়া : আমাদের বাড়িতে তার আসা-যাওয়া আছে।
ইচ্ছা-অনিচ্ছা : তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কিছু যায় আসে না।
বেচা-কেনা : উৎসবের বাজারে বেচা-কেনা বেশ জমে উঠেছে।
জন্ম-মৃত্যু : জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে।
দেনা-পাওনা : দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷
ভালো-মন্দ : মানুষের চরিত্রে ভালো-মন্দ দুদিকই থাকে।
হার-জিত : খেলায় হার-জিত থাকবেই।
৫. অনুকার ধ্বনিযোগে :
টুপটাপ : টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
টুংটাং : চুড়ি বাজে টুংটাং।
চিকচিক : ‘চিকচিক করে বালি কোথা নাই কাদা।
শনশন : শনশন করে বায়ু বয়।
ছলছল : তার চোখ ছলছল করছে।
টনটন : হাতটা ব্যথায় টনটন করছে।
এক বা একাধিক অর্থপূর্ণ ধ্বনির সমষ্টিকে শব্দ বলে। অর্থই শব্দের প্রাণ। শব্দই বাক্যে ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করে। এজন্য নতুন নতুন শব্দগঠন করতে হয়। নানা উপায়ে শব্দগঠন হতে পারে। যেমন :
১. ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ‘কার’ যোগ করে :
ব্ + ণ + ডু + f = বাড়ি
ত্ + ৃ + ণ = তৃণ
এ রকম : গাড়ি, বাবা, বিষ, নৌকা, কাকলি, রাজশাহী ইত্যাদি।
২. ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ‘ফলা’ যোগ করে
ক্ + র = ক : বক
ক্ + ল = ক্ল : ক্লান্ত
এ রকম : চক্র, বাক্য, পদ্ম, রান্না ইত্যাদি।
এগুলো হচ্ছে শব্দগঠনের প্রাথমিক উপায়।
বাংলা ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলোকে বিশ্লেষণ করা বা ভাঙা যায় না, সেগুলোকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন : হাত, পা, মুখ, ফুল, পাখি, গাছ ইত্যাদি।
আবার কিছু শব্দ আছে যা বিভিন্ন উপায়ে বা প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে। সেগুলোকে বলা হয় সাধিত শব্দ। যেমন :
ডুব্ + উরি = ডুবুরি
ঘর + আমি = ঘরামি
মেঘ + এ মেঘে ইত্যাদি৷
সাধিত শব্দ নানা উপায়ে গঠিত হতে পারে :
১. মৌলিক শব্দযোগে : পাগল + আমি = পাগলামি
বই + পত্র = বইপত্র
২. শব্দের শেষে বিভক্তি যোগ করে : আমা + কে আমাকে
বাড়ি + র = বাড়ির
চট্টগ্রাম + এ = চট্টগ্রামে
৩. শব্দের আগে উপসর্গ যোগ করে :
অ – অকাজ, অভাব, অনীল, অচেনা, অথৈ।
আ – আধোয়া, আলুনি, আগাছা, আগমন, আকণ্ঠ, আসমুদ্র।
নি – নিখুঁত, নিলাজ, নিরেট, নির্ণয়, নিবারণ, নিষ্কলুষ।
বি – বিভুঁই, বিফল, বিপথ, বিজ্ঞান, বিশুদ্ধ, বিবর্ণ, বিশৃঙ্খল
সু – সুনজর, সুখবর, সুদিন, সুনাম, সুকণ্ঠ, সুনীল, সুচতুর।
৪. শব্দের পরে প্রত্যয় যোগ করে :
আই : ঢাকাই, নিমাই, জগাই, মিঠাই।
উক : ভাবুক, মিশুক, মিথ্যুক, লাজুক।
ইক : সাহিত্যিক, বৈদিক, দৈনিক, মাসিক।
অন : কাঁদন, বাঁধন, ভাঙন, জ্বলন৷
খানা চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, ছাপাখানা।
অনীয় : করণীয়, বরণীয়, স্মরণীয়।
৫. সন্ধির সাহায্যে :
বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয় | শুভ + ইচ্ছা = শুভেচ্ছা |
শীত + ঋত = শীতার্ত | পদ্ + হতি = পদ্ধতি |
সম্ + তাপ = সন্তাপ | সম্ + বাদ = সংবাদ |
দিক্ + অন্ত দিগন্ত | পরি + ছদ = পরিচ্ছদ |
৬. সমাসের সাহায্যে :
বসতের জন্য বাড়ি = বসতবাড়ি
মুখ চন্দ্রের ন্যায় = মুখচন্দ্ৰ
নদী মাতা যার = নদীমাতৃক
দুই দিকে অপ (জল) যার = দ্বীপ
রীতিকে অতিক্রম না করে = যথারীতি
৭. শব্দদ্বৈতের মাধ্যমে :
বাড়ি > বাড়ি বাড়ি
ঘরে > ঘরে ঘরে
ঢং > ঢং ঢং
লাল > লাল লাল
দলে > দলে দলে
১. “মনে কর, তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছ হনহনিয়ে। তোমার পায়ের কাছ দিয়ে সড়সড় করে চলে গেল একটা সাপ! ভয়ে তোমার গা ছমছম করে উঠল। মাথা ঘুরে উঠল বনবন করে। তুমি ভেউ ভেউ করে না কেঁদে খাঁ খাঁ রোদ্দুরেই শাঁ শাঁ করে দৌড়ে বাড়ি চলে এলে।”
- এই অনুচ্ছেদে ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। তুমি সেগুলো নির্দেশ কর এবং এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে তুমিও একটি অনুচ্ছেদ লেখ।
২. “দিন দিন চাষের জমি-জমা কমছে। বন-টন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। মাঠে-মাঠে ফসল নেই। বনে- বনে জীব-জন্তু নেই। বছর-বছর লোকজন বাড়ছে। বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, কল-কারখানা হচ্ছে। খাল-বিল, পুকুর-টুকুর দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরিবেশ ও ভবিষ্যতের জন্যে এটি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।”
— উপরের অনুচ্ছেদে বিভিন্ন রকম দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোনটি কোন ধরনের দ্বিরুক্ত শব্দ প্রয়োগ লক্ষ করে অর্থসহ তার একটি তালিকা তৈরি কর।